তোমরা এমন কিছু কিছু মানুষ নিশ্চয় দেখেছ যাদের শরীরে মায়ামমতা অত্যন্ত বেশী৷ বিপদে আপদে সবাই তাঁদের দ্বারস্থ হয়, তাঁরাও বিপন্ন মানুষকে বাঁচাবার জন্যে আপ্রাণ চেষ্টা করে থাকেন৷ নিজেকে বিপদে ফেলেও অন্যকে বাঁচাবার চেষ্টা করেন৷ একটি ঘটনার কথা মনে পড়ল৷
সেটি ১৯৪৬–৪৭ সালের কথা৷ ভারতে নানান স্থানে তখন সাম্প্রদায়িকতার কৃশাণু জ্বলছে৷ এই আগুন জ্বালাতেন বা জ্বালিয়েছিলেন রাজনৈতিক নেতারা৷ আমি তাঁদের জন্যে ঘৃণা সূচক পলিটিক্যাল পিগ (হ্মপ্সপ্তন্ব্ধন্ন্তুত্র হ্মন্ন্ধ) শব্দটি ব্যবহার করেছিলুম৷ তাদের কাছে মানুষের জীবনের দাম ছিল না৷ তাদের উদ্দেশ্য ছিল যে কোন পন্থায় তাদের রাজনৈতিক মতলব হাসিল করা৷ এজন্যে মানুষ মরে মরুক....শান্তির নীড় গ্রামগুলি ওই আগুনের লেলিহান শিখায় জ্বলে জ্বলুক, রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সিদ্ধি ছিল তাদের কাছে সবচেয়ে বড় কথা৷ আমরা যে পাড়াটিতে থাকতুম সেটি ছিল সংখ্যালঘু ও সংখ্যাগুরু দুই সম্প্রদায়েরই বাসভূমির সীমান্তরেখা৷ আমাদের বাড়ীটি ছিল সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের পাড়ার শেষ হবার কয়েক পা মাত্র দূরে৷
স্থানটি বিহারের একটি ছোট্ট শহর৷ তখন সন্ধ্যেবেলা৷ একজন বাংলাভাষী সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের লোক সিল্কের লুঙ্গি বেচতে আমাদের পাড়ায় প্রায় ঢুকে পড়েছিল৷ আমরা তাকে তাড়াতাড়ি আমাদের পাড়া ছেড়ে সংখ্যালঘু অধ্যুষিত পাড়ায় চলে যেতে বললুম৷ আমাদের বাড়ী থেকে প্রায় একশ’ হাত দূরে৷ লোকটি ছিল ময়মনসিং জেলার৷ একে বিহারে সে কখনও আসেনি, তার ওপর এখানকার ভাষাও সে ভাল জানত না৷ সে বললে–‘‘কি করে যাব কর্ত্তা, সেখানে তো আমার জানা–চেনা কেউ নেই৷’
আমার এক অতি নিকট আত্মীয় ওই সময় আমাদের বাড়ীতে ছিলেন৷ তিনি তার হাত ধরে টেনে আমাদের বাড়ীতে ঢুকিয়ে নিলেন৷ লোকটি তখন ভয়ে কাঁপছে৷ চারিদিকে দাঙ্গা–কাজিয়া তখন চরম অবস্থায় পৌঁছেছে৷ সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের লোকেরা আমাদের বাড়ীতে এসে বললে–সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের লোকটিকে তোমাদের বাড়ীতে ঢুকতে দেখেছি, তোমরা ওকে আমাদের হস্তে সমর্পণ করো৷
আমাদের সেই আত্মীয়টি তখন বাড়ী থেকে রাস্তায় বেরিয়ে এলেন৷ তিনি সংখ্যাগুরু ওই বিরাট রণোন্মত্ত বাহিনীকে বললেন–লোকটিকে আমিই বাড়ীতে ঢুকিয়ে রেখেছি৷ লোকটি বিপন্ন৷ তোমরা যদি লোকটিকে চাও আমি তাকে তোমাদের হস্তে সমর্পণ করতে রাজী আছি–একটি সর্ত্তে৷ তোমরা আমাকে এখনই মেরে ফেল....তারপর আমার মৃতদেহের ওপর দিয়ে চলে যাও ওই বাড়ীতে....লোকটিকে বাড়ী থেকে বার করে আনো৷ যতক্ষণ আমি বেঁচে আছি ততক্ষণ আমি তোমাদের ওই লোকটির কাছে যেতে দোবনা–তা সে সংখ্যায় তোমরা হাজারই হও, লাখই হও৷ আক্রমণকারীরা বলতে বলতে গেল, ‘‘দেওতা হ্যায়৷’’ (শব্দ–চয়নিকা, ১৩শ খণ্ড)