কম্যুনিষ্ট রাষ্ট্রগুলিতে তোমরা প্রদমন, অবদমন ও দমনের একটা ত্রিভুজ পুরোপুরি কার্যকরী দেখতে পাবে৷ এই তিনটি ত্রুটির ওপর কম্যুনিজম আধারিত৷ কিন্তু এই তিনটি ত্রুটির মধ্যে সব চাইতে বেশি ঘটেছে দমন, তারপর ঘটেছে অবদমন ও সব চাইতে কম ঘটেছে প্রদমন৷ এই প্রদমন, অবদমন ও দমনের ফলে সৃষ্ট শারীরিক ও মানসিক যন্ত্রণা থেকে জনসাধারণকে অবশ্যই মুক্তি দিতে হবে৷ এই তিনটি মানসিক পীড়ন মানুষের মনকে ভেঙ্গে চুরে তছনছ করে দিয়েছে৷
মানুষের মনের স্বভাবই হচ্ছে সে বিস্তার লাভ করতে চায়৷ কিছু বিরুদ্ধশক্তি আছে যা মনের বিস্তারে বাধা দেয় তবুও মন বিস্তারের চেষ্টা করবেই৷ মানুষের মনের এই বিস্তার লাভের আকাঙক্ষাকে আটকে বন্ধ করে দিতে যে শক্তির প্রয়োগ হয় সংস্কৃতে তাকে বলা হয় ‘‘প্রদমন’’৷
যখনই তুমি নিজের অনুভূতিকে ব্যক্ত করার স্বাধীনতা চাইবে অথবা যখনই তুমি একটা ভয়শূন্য মুক্ত পরিবেশ চাইবে তখনই তাতে হুমকী ও ৰাধা আসে৷ উদাহরণ–স্বরূপ বলা যায় ইশ্লামিক দেশে মেয়েরা খেলাধুলায় অংশ নিতে চায় কিন্তু তাতে তাদের বাধা আছে৷ কম্যুনিষ্ট রাষ্ট্রে অনেক লোক আছে যারা কম্যুনিজমের সমালোচনা করতে চায় কিন্তু তা করা সম্ভব হয় না কারণ তারা জানে যে তা করতে গেলেই তাদের শ্রম শিবিরে (concentration camp) পাঠিয়ে দেওয়া হবে৷ এমন অনেক জায়গাও আছে যেখানে মানুষ স্বাধীনভাবে গান–বাজনা করতে চায় কিন্তু তা করতে গেলেই শাস্তি পেতে হয়৷ সংস্কৃতে এই ধরনের বাধাপ্রয়োগকে বলা হয় ‘‘অবদমন’’৷
অবদমন সরাসরি অবচেতন মনকে প্রভাবিত করে৷ এতে মানুষের মানসিক সংরচনা ধীরে ধীরে ভীষণ ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় ও শেষ পর্যন্ত মনটা পুরোপুরি পরিবর্ত্তিত হয়৷ এর ফলে মানুষের মনে পরাজিত মনোভাব ও হীনম্মন্যতা ঢুকে যায়৷ তোমাদের একটা উদাহরণ দিচ্ছি৷ কোনো এক হরিজন স্কুলের প্রধান শিক্ষক একদিন একটি ছাত্রকে খাবার জল আনতে বললেন কিন্তু ছেলেটি গেল না৷ সে তার হরিজন নয় এমন এক বন্ধুকে নিচু গলায় সেই জল আনতে বলল৷ কিন্তু প্রধান শিক্ষক তাতে বাধা দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, কেন সে নিজে জল আনতে যাচ্ছে না৷ উত্তরে ছেলেটি বলল, ‘‘স্যার, আমি অস্পৃশ্য জাতির ছেলে৷ আমার ছোঁয়া জল আপনি কেমন করে খাবেন?’’ অবদমন মনকে কীভাবে বদলে দেয় এটা একটা উদাহরণ৷
এই মনস্তত্ব দীর্ঘদিন ধরে ভারতবর্ষে রয়েছে৷ তথাকথিত নিচুজাতির লোকেরা ভয়ে তোমাকে এক গ্লাস জল দিতে অস্বীকার করবে কারণ হীনম্মন্যতার মনস্তত্ব শত শত বৎসর ধরে তাদের মনে গেঁথে দেওয়া হয়েছে৷ শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে তথাকথিত অন্তজ শ্রেণীর মানুষেরা লাঞ্ছনা ও গঞ্জনা পেয়েছে৷ ফলে তাদের মন অসাড় হয়ে গিয়েছে৷ মর্মান্তিক ভাবে এই দশাকে তারা নিজেদের ভাগ্যফল বলে মেনে নিয়েছে৷
যখন তুমি কোনো কিছু কাজ করে ফেলেছ বা করার চেষ্টা করেছ তখন তোমার বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলে তোমাকে শাস্তি দেওয়া হয়, যার ফলে তোমার কিছু করার মানসিকতা চিরকালের মত হারিয়ে যায়৷ সংস্কৃতে এই ধরনের ৰাধাকে বলা হয় ‘‘দমন’’৷
প্রাচীনকালে ভারতবর্ষে প্রদমন, অবদমন ও দমন ব্যাপক ভাবে প্রচলিত ছিল৷ আর্যেরা প্রচুর পরিমাণে দুধ, ঘি, চাল প্রভৃতি দিয়ে তাদের ধর্মীয় অনুষ্ঠান পালন করত৷ এই সব খাদ্যদ্রব্য অনার্যদের কাছ থেকে জোর করে আদায় করা হত বলে তারা খাদ্যাভাবে কষ্ট পেত৷ ফলে অনার্যরা খাদ্যদ্রব্য উদ্ধার করার জন্যে আর্যদের যজ্ঞস্থলে আক্রমণ চালাত৷ অনার্যরা কি অন্যায় কিছু করত? –না৷ কিন্তু আর্যেরা এই ধারণা ছড়িয়ে দিয়েছিল যে অনার্যরা রাক্ষস–দানব৷ এইভাবে অনার্যদের মধ্যে হীনম্মন্যতা ঢুকিয়ে দেবার চেষ্টা করা হয়েছিল৷
পৌরাণিক মহাকাব্য রামায়ণের রাম ছিলেন আর্যশ্রেষ্ঠতার প্রতিভূ আর রাবণ ছিলেন অনার্যদের প্রতিনিধি৷ রামকে বলা হয় ‘‘মর্যাদা পুরুষোত্তম’’৷ ‘‘মর্যাদা পুরুষোত্তম’’ কী? যখন পরমপুরুষ এই পৃথিবীতে আবির্ভূত হন তখন মানবদেহ ধারণ করলেও তাঁর ধর্ম ও আচরণ পরমপুরুষের সমানই হয়৷ ‘‘মর্যাদা পুরুষোত্তম’’–এর এটাই অর্থ৷ তা হলেও রাম কিন্তু পরমপুরুষের মত আচরণ করেন নি৷ তিনি সেইখানে পৌঁছান নি৷ অনার্য শূদ্রক যখন তপস্যা করছিল, তাকে তিনি হত্যা করেছিলেন৷ আর্য শ্রেষ্ঠত্বাভিমানেই তিনি শূদ্রককে বধ করেছিলেন৷ তৎকালীন যুগে লোকে বিশ্বাস করত যে অনার্যরা নয়, আর্যরাই একমাত্র পুজো–পাঠ করার অধিকারী৷ কিন্তু এই গোঁড়ামি সমর্থন করা যায় না৷ অনার্যরাজ রাবণকে রামায়ণে রাক্ষস বলা হয়েছে কিন্তু তাঁর আচরণ মোটেই রাক্ষসসুলভ অশিষ্ট ছিল না৷ তিনি সীতাকে অপরহরণ করে নিজের প্রাসাদে নিয়ে যান নি৷ বরং কিছু অনুচরীসহ সীতাকে একটি স্বতন্ত্র জায়গায় রেখেছিলেন৷ তিনি সত্যসত্যই খারাপ লোক হলে এ রকমটা করতেন না৷ তা সত্ত্বেও রাম তাঁকে হত্যা করেছিলেন৷ এতে এটাই প্রমাণিত হয় যে রাম পরমপুরুষ ছিলেন না৷
প্রদমন, অবদমন ও দমননীতি আর পুঁজিবাদ ও সাম্যবাদের তাণ্ডবের ফলে সারা বিশ্বের মানুষকে প্রচণ্ড সংঘর্ষের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে৷ যেখানেই প্রদমন, অবদমন ও দমন থাকে সেখানেই মানুষকে জড়তা বা অন্ধ কুসংস্কারের (dogma) পথ ধরতে বাধ্য করা হয়৷ কম্যুনিজম ভাবজড়তা (dogma) প্রচার করে, ক্যাপিটালিজমও ভাবজড়তা প্রচার করে, ও শাস্ত্রনির্ভর তথাকথিত ধর্মমতগুলি ভাবজড়তা প্রচার করে৷ এখন মানবমনে একটা তৃতীয় মানসশক্তির অভ্যুদয়ের সময় এসেছে যেখানে প্রদমন, অবদমন ও দমন আর থাকবে না৷ মানবমনের ইপ্সিত উন্নতি হোক, মন হোক ভয়মুক্ত৷ সমন্বয় ও সহযোগিতা ভিত্তিক মানবসমাজ গড়ে উঠুক৷
মানবসমাজের এটাই পরিণত অবস্থা৷ আমরা সেই অরুণোদয়ের অপেক্ষা করছি৷ এখন সেই রশ্মির দেখাও পাওয়া যাচ্ছে৷ সে আলোকরশ্মি প্রাউটেরই৷
১৩ নভেম্বর ১৯৮৯, কলিকাতা