পরিপূর্ণ আনন্দপ্রাপ্তির পথে

লেখক
আচার্য মন্ত্রসিদ্ধানন্দ অবধূত

১৯২১সালের পূর্ণিমা শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী জন্মতিথি  আর এই কারণে, এই বৈশাখী পূর্ণিমার এই পুণ্যতিথিটি আনন্দমার্গের অনুগামীদের কাছে ‘আনন্দপূর্ণিমা’ রূপে পরিচিত৷ মানবসমাজে শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী অবদান কী–তা আমাদের জানতে হবে৷ তবে আমরা এই আনন্দপূর্ণিমার তাৎপর্য উপলব্ধি করতে পারব৷

আজকে মানুষের দিশাহারা অবস্থা৷ সর্বক্ষেত্রেই–কি আধ্যাত্মিক ক্ষেত্রে, কি অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে, কি রাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে, কি শিক্ষা–সংস্কৃতির ক্ষেত্রে–মানুষ আজ লক্ষ্যহীন ভাবে অন্ধকারে পথ হাতড়ানোর মত বিশৃঙ্খলভাবে এদিক ওদিক ছুটে চলেছে৷ ফলে মানুষ ক্রমশঃ অন্ধকার থেকে অধিকতর অন্ধকারের দিকে ছুটে চলেছে৷ আলোর সন্ধান পাচ্ছে না৷ আপাত সুখ, আপাত লোভনীয়, আপাত আকর্ষণীয়ের পেছনে ছুটে ছুটে মানুষ আজ ক্লান্ত৷ চিন্তাশীল মানুষ ভাবতে শুরু করেছে, আমরা কোথায় চলেছি? এ তো আমরা ক্রমশঃ সর্বনাশের দিকে–ধ্বংসের দিকে ছুটে চলেছি৷ কিন্তু প্রকৃত পথটা কী? তা কেউ ঠিক বুঝতে পারছেন না৷

এই পরিস্থিতিতে মানুষের প্রয়োজন বুঝে–মানুষের অভাব বুঝে শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী এমন একটা দর্শন–এমন একটা জীবনাদর্শ দিয়েছেন–যা মানুষকে জীবনের তথা সমাজের সর্বক্ষেত্রেই সার্থকতার রাস্তা দেখিয়ে দেয়৷

হ্যাঁ, সর্বক্ষেত্রেই–আধ্যাত্মিক থেকে শুরু করে অর্থনৈতিক পর্যন্ত সর্বক্ষেত্রেই তিনি সর্বপ্রকার সমস্যার সমাধানের পথ দেখিয়েছেন৷ এটা সাধারণ মানুষের কাছে অবিশ্বাস্য মনে হলেও শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী আদর্শকে মনোযোগ দিয়ে অনুধাবন করলে এই কথার সারবত্তা সবাই উপলব্ধি করতে পারবেন৷ ’

তিনি যে ‘আনন্দমার্গ দর্শন’ তথা জীবনাদর্শ দিয়েছেন–এটা সেই ভূমা আদর্শ যা বিশ্বের সমস্ত মানুষকে এক সূত্রে গ্রথিত করবে, সবাইকে এক ‘আনন্দ’পথে পরিচালিত করবে৷  আর এর যে অনুশীলনের দিক তাই মানুষের মধ্যে শুভবুদ্ধি জাগিয়ে তুলবে৷

শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী উদাত্তকণ্ঠে ঘোষণা করেছেন, ‘‘সকল মানুষের এক জাত’’, ‘‘প্রত্যেক মানুষেরই সমান অধিকার,’’ ‘‘মানুষ মানুষ ভাই ভাই,’’ ‘‘মানুষকে শোষণ করা চলবে না,’’ ‘‘ধর্মের নামে ভণ্ডামী চলবে না৷’’

শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী একদিকে যেমন ধর্মের ক্ষেত্রে সমস্ত ভেদাভেদ ও বিভ্রান্তি দূর করে সমস্ত মানুষের আধ্যাত্মিক উন্নতির জন্যে উদার আধ্যাত্মিক আদর্শ ও সর্বকুসংস্কারমুক্ত অষ্টাঙ্গিক যোগসাধনা পদ্ধতি দিয়েছেন তেমনি অন্যদিকে শিক্ষা ক্ষেত্রে নব্যমানবতাবাদ ভিত্তিক নূতন শিক্ষা ব্যবস্থা প্রবর্তন করে মানুষকে জীবনের সর্বক্ষেত্রে সর্বাত্মক মুক্তি পথের পথ নির্দেশনা দিয়েছেন৷ সঙ্গীতের ক্ষেত্রে তিনি পাঁচ সহস্রাধিক ‘প্রভাত সঙ্গীত’ রচনা করে ও তাতে নিজেই সুর দিয়েছেন৷ এই প্রভাত সঙ্গীতের মূল্যায়ন করতে গিয়ে রবীন্দ্রভারতী ও বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য ও তিরুপতি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন আচার্য ডঃ রমারঞ্জন মুখোপাধ্যায় মন্তব্য করেছেন, ‘‘প্রভাত সঙ্গীত অনুধ্যান করলে আমরা প্রকৃত সংস্কৃতির সূর্যালোকের প্রকাশ ঘটাতে পারব আর তার সঙ্গে শাশ্বত মূল্যবোধ, নৈতিক মূল্যবোধ, আধ্য্যাত্মিক মূল্যবোধ সব কিছুরই আমরা পুনর্জাগরণ ঘটাতে পারব৷’’

সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও আজ যে আদর্শগত চরম শূন্যতা বিরাজ করছে সেখানেও সেই অভাব পূর্ণ করতে শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী, (যাঁর লৌকিক নাম শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকার) মানবসমাজকে উপহার দিয়েছেন এক যুগান্তকারী সমাজ দর্শন ‘প্রগতিশীল উপযোগ তত্ত্ব’–সংক্ষেপে ‘প্রাউট’৷ এই ‘প্রাউট’ আজ বিশ্বের বিশেষ করে বিদ্বৎমহলে এক প্রচণ্ড আলোড়ন সৃষ্টি করেছে৷

তাঁর আদর্শের বিভিন্ন দিককে সংগ্রথিত করে অতি সংক্ষেপে তাঁর ভাষাতেই বলা যায় ঃ ‘‘আমি চাই প্রতিটি মানুষ জীবনের ন্যুনতম প্রয়োজনপূর্ত্তির গ্যারাণ্টী পাক৷ প্রতিটি মানুষ তার মানসিক ক্ষেত্রের সমস্ত সম্ভাবনার বিকাশের পূর্ণ সুযোগ পাক৷ প্রতিটি মানুষ শাশ্বত সত্য উপলব্ধির সমান সুযোগ পাক ও বিশ্বের সকল উৎকর্ষ ও গৌরবের অধিকারী হোক৷ প্রতিটি মানুষ সেই শাশ্বত অনন্ত সত্তার দিকে এগিয়ে চলুক৷’’

শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী এই সর্বানুসূ্যত আদর্শ আজকের বিশ্বের সমস্ত সমস্যারই সমাধানের অভ্রান্ত পথের নির্দেশনা দিচ্ছে৷ সেই দিক থেকে শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী শুভজন্মতিথি –‘আনন্দপূর্ণিমা’ এক গভীর তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে মানুষের সামনে হাজির হয়েছে৷ এই তাৎপর্য যত গভীরভাবে আমরা উপলব্ধি করার চেষ্টা করব–ততই আমাদের কল্যাণ–বিশ্বের কল্যাণ সাধিত হবে৷

সাথে সাথে তাঁর জন্মদিনের উৎসব সেদিনই সার্থক হবে যেদিন আমরা তাঁর আদর্শের সঙ্গে তাঁর জীবন দর্শনের সঙ্গে নিজেদের মিলিয়ে দিয়ে পরিপূর্ণ আনন্দপ্রাপ্তির দিকে যাত্রা শুরু করবো৷